একজন সফল আলোকচিত্র শিল্পী মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু। প্রত্যেক শিল্পীরই উৎকৃষ্টতার প্রধান দিক হলো তার নিজস্ব স্টাইল। যার স্টাইল মানুষের হৃদয়ে যতো বেশি স্থান করে নেবে, তিনি ততো বেশি সার্থক শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করবেন। এ সময়ের সর্বাধিক আলোচিত আলোকচিত্র শিল্পী মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু তাঁর নিজস্ব স্টাইলরে অনবদ্য প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে তাঁর শিল্পগুণ ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের মাঝে। একজন গুণী শিল্পী হওয়া একদিনের কাজ নয়।

মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টুও রাতারাতি চিত্রশিল্পী বনে যাননি। দীর্ঘদিনের সাধনা, পরিশীলন ও পরিশ্রমের মধ্যদিয়ে আজ তিনি তাঁর নিজস্ব অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু শুধু একজন আলোকচিত্র শিল্পীই নন, তিনি বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে চিত্রশিল্পই তাঁর নেশা এবং পেশা। মাত্র ১৩ বছর বয়সে হাতে তুলে নেন ক্যামেরা মিন্টু। বাবা লুৎফর রহমান ছিলেন দেশের প্রথিতযশা আলোকচিত্র শিল্পী, যিনি বাংলাদেশের অনেক ইতিহাস ঐতিহ্যের ছবি তুলে সাক্ষী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত পছন্দের ফটোগ্রাফার। সেই সুবাদে তিনি বঙ্গবন্ধুর অনেক আলোচিত ছবি তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করেছেন।

তাছাড়া তিনি বেতার বাংলার প্রকাশনা বিভাগে চাকুরি করেছেন। ছোটবেলা থেকেই মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু দেখেছেন বাবার হাতে ক্যামেরা। একসময় সেই ক্যামেরা হয়ে উঠে মিন্টুর হাতের খেলনা। সেই ক্যামেরাই আজকে মিন্টুর খ্যাতি দেশময় ছড়িয়ে দিয়েছে। মূলত বাবার স্মৃতি ধারণ করার জন্যই মিন্টু ক্যামেরা বয়ে ছুটে চলেছেন শহরের অলি-গলি, পথে-প্রান্তে। এমন কোন অনুষ্ঠান নেই যেখানে মিন্টুর পদচারণা নেই। দুরন্ত এই ফটোগ্রাফার উড়ন্ত পাখির মতো ক্লান্তিহীন ছুটে চলেন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। নেশা একটাইÑ গুণীজনদের ক্যামেরা বন্দি করা। ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টুর দুর্লভ সুযোগ হয়েছিল ধানমন্ডিস্থ কবিভবনে কাজী নজরুল ইসলামকে দেখার। কবিভবনে তিনি গিয়েছিলেন বাবার সঙ্গে। সঙ্গে ছিল তার ছোট বোন ও বড় বোন। সেই দুর্লভও স্থির হয়ে আছে বাবা লুৎফর রহমানের ক্যামেরায় তোলা ছবিতে। বাবার সুবাদে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে স্বচক্ষে দেখার সুযোগ মিন্টু পেয়েছিলেন সেই ছোট্ট বেলাতেই। দেশ-বিদেশের বহু বরেণ্য ব্যক্তিদের ছবি মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু ধারণ করেছেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য- বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, সাবেক রাষ্ট্রপতিগণসহ বর্তমান রাষ্ট্রপতি, চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন, কবি শামসুর রাহমান, সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন, রাভিনা টেন্ডন, নায়িকা শ্রীদেবী, রেখা, মুনমুন সেন, নায়ক শাহরুখ খান, সালমান খান, সালমান শাহ, সুনীল শেঠি, চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শাবানা, ববিতা, বিপাশা, শাবনূর, মৌ, রিয়া, বিখ্যাত ক্রিকেটার ইমরান খান, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অনেক বিখ্যাত গুণীজন মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টুর ক্যামেরায় বন্দি হয়েছেন। আলোকচিত্রে কি মানুষ, কি স্থাপনা অথবা যে কোন অবয়বকে শিল্পমণ্ডিত করার লক্ষ্যে মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু এক জাদুকরী দৃষ্টি রাখেন ক্যামেরায়। সেজন্যেই কোন সাধারণ বিষয়ও তাঁর ক্যামেরায় অসাধারণ হয়ে ফুটে ওঠে। মডেলদের ছবি তুলে তিনি মডেল শিল্পীকেও অবাক করে দেন। এর পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে ছবি তোলার আগে মডেল ও আলোকচিত্রীর মাঝে মানসিকভাবে একটা বোঝাপড়া করে নেন মিন্টু। শুধু মডেল ও স্থিরচিত্রই নয়, মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টুর তোলা ছবি থেকে প্রায় শতাধিক বিনোদন পত্রিকার প্রচ্ছদও করা হয়েছে। কাজের সূত্রে বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছেন এ শিল্পী। সেসব দেশেও বরাবরই তাঁর ক্যামেরা ছিল সচল। নানা দুর্লভ অবয়বের ছবি তুলেছেন তিনি। নিউজ মিডিয়া দিয়ে মিন্টুর কর্মজীবন শুরু। পরে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর মহিলাঙ্গনে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। বর্তমানে শোবিজ পত্রিকার প্রধান ফটোসাংবাদিক হিসেবে কর্মরত। তাছাড়া বেতার বাংলা, সিনে তারকায়ও তিনি কাজ করেন। মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু তাঁর এই অসাধারণ কর্মক্ষমতার কারণে সুধীমহলে শুধু প্রশংসিতই নন, পুরস্কৃতও হয়েছেন। পেয়েছেন শেরে বাংলা পদক, মাদার তেরেসা পদক, কাজী নজরুল ইসলাম পদক, কবি আব্দুল হাকিম পদক, স্বাধীনতা সংসদ পদক, এশিয়ান জার্নালিস্ট চ্যারিটেবল সোসাইটি পদকসহ নানা পুরস্কার। এছাড়াও তিনি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, এবং ফটোগ্রাফি সোসাইটির সদস্য। মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু একাধারে লেখক, প্রয়োজক ও একজন সফল পরিচালক। একুশ শতকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় ফটোগ্রাফিও পারে বিশাল ভূমিকা রাখতে। তাই নতুন প্রজন্মের জন্যে ‘মডেল ফটোগ্রাফী’ নামে একটি বই লিখেছেন, যার মাধ্যমে একজন তরুণ অল্পসময়ে হয়ে উঠতে পারে সফল একজন ফটোগ্রাফার। ইতোমধ্যে এ বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। দেশের বাইরেও এ বইটি বেশ প্রশংসিত। এছাড়াও মিন্টুর লেখা বই ‘চিরঞ্জীব শেখ মুজিব’, ‘বাঙালী জাতির মহানায়ক’, ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ বহুল আলোচিত হয়েছে। আলোকচিত্রী মিন্টু প্রযোজনা করেছেন প্যাকেজ নাটক ‘স্বাধীন’, পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি ‘মৌমাছি’, ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ ও ‘শিল্পী’। এসব ছবিও হয়েছে দর্শকপ্রিয়। মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু সদা হাস্যোজ্জ্বল ও সদালাপী। যার ফলে অতি অল্পসময়েই যে কোন মানুষের সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। দেশের প্রথিতযশা অনেক ব্যক্তির সাথেই রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। প্রয়াত বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সাথেও ছিল তাঁর অন্তরঙ্গতা। মিন্টুকে তিনি খুবই স্নেহ করতেন। বাংলাদেশের ফটোসাংবাদিকতার জগতে অনন্য কৃতী পুরুষ মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু ১৯৬২ সালের ২১ জানুয়ারি মাসে রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। স্ত্রী ও দুই পুত্র সন্তান নিয়ে সুখি সংসার তাঁর।
Leave a Reply